নির্মানাধীন সিলেট জেলা হাসপাতাল স্থান নির্বাচন: জনকল্যাণ পর্যালোচনা

 

মো: আব্দুল মালিক:

সম্প্রতি সিলেটে টক অব দা টাউন হচ্ছে নির্মাণাধীন জেলা হাসপাতাল। সারাদেশের ন্যায় রাজনৈতিক উত্তাপহীন সিলেটে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক আন্দোলন দিন দিন উত্তাপ ছড়াছে। যে আন্দোলনে ক্ষমতাসীন জোটের শরীক অনেক রাজনৈতিক দল ও সহযোগি সংগঠন ও রয়েছে। সিলেট শহরের চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে রিকাবীবাজার পয়েন্টের মধ্যখানে আবুসিনা ছাত্রাবাসের জায়গায় ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ইং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতালের ১৫ তলা ভবনের ভিত্তি প্রস্ত স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ০৯ জুলাই ২০১৮ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান GKBPL-PEL (JV) কে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবুসিনা ছাত্রাবাস ভেঙ্গে নির্মাণকাজ শুরু করতে গেলে বিষয়টি সর্ব সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়। আর তখন থেকেই স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক কয়েকটি সংগঠন আবুসিনা ছাত্রাবাসকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণ করে অন্যত্র জেলা হাসপাতাল নির্মাণের দাবী তোলে নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকে। তাদের এ আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকাও যোগ দিয়েছে। আবার উক্ত স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষেও একাধিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ক্রিয়াশীল রয়েছে। এ নিয়ে দু পক্ষ প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় উক্ত স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে বিপক্ষে যে বক্তব্য এসেছে তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি।

(১) ‘আবুসিনা ছাত্রবাস ভবন সংরক্ষনের চলমান আন্দোলনে সংহতি’- দৈনিক জালালাবাদ-২২ মার্চ ২০১৯। এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছে যেসব রাজনৈতিক দল তাহচ্ছে সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রীপার্টি ও ওয়ার্কাস পার্টি, জাসদ, বাসদ, ন্যাপ, সিপিবি সিলেট শাখা। সামাচিক সংগঠন সনাক, সুজন, বাপা, মতিন উদ্দিন চৌধুরী যাদুঘর ইত্যাদি। তাদের দাবী এই ভবনের সাথে মুক্তিযোদ্ধ ও সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের ইতিহাস জড়িত। তাই আবুসিনা ছাত্রাবাস সংরক্ষণ করা জরুরী।

(২) ‘ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেই সিলেট জেলা হাসপাতাল হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ দৈনিক শুভ প্রতিদিন ১৮ এপ্রিল ২০১৯।

(৩) ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস রক্ষায় নতুন প্রস্তাব’ দৈনিক প্রথম আলো ২০ এপ্রিল ২০১৯।
(৪) ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন: নাগরিক উদ্বেগ শীর্ষক সেমিনার আজ’-দৈনিক সিলেটের দিনরাত ১৭ মে ২০১৯। উক্ত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, পরিবেশ আন্দোলন (বাপার) সহ সভাপতি, মানবাধিকার নেত্রী এড. সুলতানা কামাল, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার বর্তমান ও সাবেক সভাপতি যথাক্রমে ড. এ. কে আব্দুল মুবিন ও সি.এম তোফায়েল সামী, সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ হেরিটেজ সোসাইটির সভাপতি সোহেল আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট সিলেট শাখার সভাপতি স্থপতি সৈয়দা জেরিনা হোসেন প্রমুখ বক্তারা ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে আবুসিনা ছাত্রাবাস সংরক্ষণ এবং যানজট এড়াতে হাসপাতাল অন্যত্র নির্মাণের জোর দাবি জানান।

(৫) আবুসিনা ছাত্রাবাস ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করার সুযোগ নেই। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। দৈনিক সিলেটের ডাক ১৮ মে ২০১৯।

(৬) ‘ছাত্রাবাসের একাংশ ঠিক রেখে নির্ধারিত স্থানেই হাসপাতাল’ – মত বিনিময় সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দৈনিক প্রথম আলোয় ১৯ মে ২০১৯’।

(৭) ‘সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর একাত্মতা প্রকাশ, ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ করেই নির্ধারিত জায়গায় সিলেট জেলা হাসপাতাল হবে।’ দৈনিক সিলেটের ডাক- ১৯ মে ২০১৯।

(৮) ‘আবুসিনা ভবন রক্ষার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অহŸান’- দৈনিক শ্যামল সিলেট ২৭ মে ২০১৯।

(৯) ‘ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তপক্ষেপ দাবি’-দৈনিক প্রথম আলো-৩১ মে ২০১৯। ৩০ মে ২০১৯ সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবুসিনা ছাত্রাবাস রক্ষার দাবিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারক লিপি প্রদানের মাধ্যমে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। উপরোক্ত বক্তৃতা বিবৃতি পর্যালোচনায় অনুমিত হয় সরকারপক্ষ ঐতিহ্য রক্ষার স্মারক হিসেবে আবুসিনা ছাত্রাবাসের একাংশ সংরক্ষণ করে উক্ত স্থানে হাসপাতাল নির্মাণে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা আবুসিনা ছাত্রাবাস পুরো সংরক্ষণ করে এ স্থানে হাসপাতাল নির্মাণ না করার দাবিতে এখনো অনড়। বল এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে।

বর্তমান আবুসিনা ছাত্রাবাস ছিল ‘সিলেট মেডিকেল স্কুল’। এটি ১৯৪৮ সালে স্থাপিত হয়। ১৯৬২ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে মেডিকেল স্কুল ও স্কুল সংলগ্ন বর্তমান শামসুদ্দিন হাসপাতাল পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা সমাধানে তৎকালীন ছাত্ররা জোর করে সিলেট মেডিকেল স্কুলটি দখল করে চিকিৎসা জগতের কিংবদন্তী ‘আবু আলী ইবনে সিনা’র নামে হোস্টেলের নাম করণ করেন ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায় নির্মাণাধীন জেলা হাসপাতালে থাকবে আউটডোর, ডায়গনস্টিক সেন্টার, কার্ডিয়াক, জেনারেল ওটি, আইসিইউ, সিসিইউ, গাইনি এন্ড অবস অর্থোপেডিক, ইএনটি, বার্ণ ইউনিট সহ ১২টি বিভাগ। ১৫ তলা ভিত বিশিষ্ট ৮তলা ভবনের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা।

উক্ত স্থানে জেলা হাসপাতাল নির্মাণের পূর্বে তিনটি দিক বিবেচনার দাবী রাখে।
(১) সিলেট মহানগরীর উপর এর প্রভাব কতটুকু পড়বে।
(২) সিলেট জেলার সাধারণ মানুষের কল্যাণে কতটুকু কাজে আসবে।
(৩) সুষম ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এই স্থান কতটুকু উপযোগী।

সিলেট মহানগরীর প্রধান সমস্যা হচ্ছে যান-জট। আর এই যানজটের মূল কারণ অপরিসর ও অপর্যাপ্ত রাস্তা এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। মহানগরীর রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অন্তত তিনবার বড় ধরনের ভাঙ্গাচুরা করা হয়েছে। পাগলা ডিসি খ্যাত ফয়জুল্লা ডিসির সময় ১ম বার, বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার থাকার সময় ২য় বার এবং বর্তমানে মেয়র হিসেবে তিনি তা ৩য় বার রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ করেছেন। কিন্তু এই সম্প্রসারণ যানজট নিরসনে খুব বেশিদিন অবদান রাখবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া অদুর ভবিষ্যতে রাস্তা সম্প্রসারণের আর সুযোগ নেই বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া দিন দিন মহানগরীর জনসংখ্যা বাড়বে বৈ কমবেনা।

সিলেট শহরের উত্তর, উত্তর পূর্ব ও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে মূল শহরে আসার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে আম্বরখানা থেকে চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার হয়ে একটি রাস্তা এবং চৌহাট্টা নয়াসড়ক হয়ে আরেকটি রাস্তা। বর্তমানে এই দুই রাস্তা দিয়েই যান ও জন চলাচলে যানজট লেগেই যায়, যা কোনো কোনো সময় মারাত্মক আকার ধারণ করে। সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী ওসমানী বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে উন্নীত করা। তাছাড়া সিলেট সুনামগঞ্জ নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ হয়ে একটি আন্তঃজেলা রাস্তা নির্মাণ। অদুর ভবিষ্যতে এই দুটি দাবী বাস্তবায়িত হলে আম্বরখানা দিয়েই মূল শহরে গমনাগমনের হার আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে শহরে মানুষের আগমন নির্গমণের হার তত বাড়বে। কিন্তু সে অনুযায়ি রাস্তা সম্প্রসারণ বা বিকল্প রাস্তা তৈরীর কোন সুযোগ নেই। আম্বরখানা-জিন্দাবাজার-বন্দরবাজার রাস্তাটি সিলেট শহরকে দু ভাগে বিভক্ত করেছে। সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা ইত্যাদি হয় এই রাস্তার আশে পাশে বা এর পশ্চিম অংশে গড়ে উঠেছে। তাই শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলাচলের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে আম্বরখানা-চৌহাট্টা-রিকাবী বাজার বন্দর রাস্তা। এই রাস্তায় রয়েছে সিলেট বিমান বন্দর, সিলেট ক্যাডেট কলেজ, বন বিদ্যালয়, আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, স্টেডিয়াম সংলগ্ন সরকারী হাইস্কুল, আম্বরখানা জামে মসজিদ, আম্বরখানা স্কুল ও কলেজ, স্কলার্স হোম, দরগাহে হযরত শাহজালাল মাজার, মসজিদ ও মাদ্রাসা, সোনালী ব্যাংক, দরগা গেইট শাখা, পূবালী ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংকের শাখা, সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ-যেখানে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সভা সমাবেশ হয়। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মহিলা কলেজ, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, এইডেড হাইস্কুল, মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল, শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল, সিলেট বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার, স্কাউট ভবন, শহর সমাজসেবা অফিস, সিলেট স্টেডিয়াম, কবি নজরুল অডিটোরিয়াম, মোহাম্মদ আলী জিমনেসিয়াম, পুলিশ লাইন ও পুলিশ লাইন হাইস্কুল, ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মঈন উদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, মদন মোহন কলেজ, মইনুনেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নির্ম্বাক আশ্রম, মনিপুরী রাজবাড়ি, জেলা ও উপজেলা প্রাণী সম্পদ হাসপাতাল। মির্জা জাঙ্গাল হাইস্কুল, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ ব্যাংক, পূবালি ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিস, ফায়ার সার্ভিস, কাজীর বাজার মাদ্রাসা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা জেলা ও বিভাগীয় অফিস, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন অফিস, জেলা ও উপজেলা সাব রেজিষ্টার অফিস, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, সার্কিট হাউস, রাজা জিসি হাইস্কুল, পাইলট হাইস্কুল, অগ্রগামী বালিকা স্কুল, জর্জকোট, মহানগর কোর্ট, জেলা প্রশাসনের কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয়, সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, হেড পোস্ট অফিস, সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল, সিলেটের ব্যবসার আড়ৎ খ্যাত বন্দরবাজার কালিঘাট, মহাজন পট্টি, লালদিঘির পার, মোবাইল মার্কেট করিমউল্লা, গরু ও মাছের আড়ৎ এসব স্থায়ী স্থাপনা রয়েছে। তাছাড়া কাজির বাজার ব্রীজ ও কিং ব্রীজ দিয়ে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাতায়াতের জন্য এই রাস্তা সহজ। উল্লেখ্য সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে রয়েছে আন্ত জেলা ও আন্ত উপজেলা বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে ষ্টেশন, বেশিরভাগ বিভাগীয় অফিস, নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, টেকনিক্যাল কলেজ, তাবলীগ জামাতের মারকাজ, মসজিদ, ফলের আড়ৎ ইত্যাদি।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের ২৫% রাস্তা থাকা প্রয়োজন। পরিবেশবিদদের মতে মোট আয়তনের ২৫% গাছপালা থাকা প্রয়োজন। সিলেট শহরে রাস্তা ও গাছপালা ৩/৪% আছে কি না সন্দেহ। ব্যক্তিগত জায়গায় আজ যেসব গাছপালা আছে আগামীকাল তা নাও থাকতে পারে। তাই এই স্থানে যান ও জন বান্ধব হাই রাইজিং বিল্ডিং স্থাপন করে পরিবেশ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করা নাগরিক জীবনে কী প্রভাব ফেলবে তা খতিয়ে দেখা জরুরী। ১৯৬২ সালে যখন সিলেট মেডিকেল স্কুলকে কলেজে উন্নীত করা হয় তখন কর্তৃপক্ষ এই স্থানে তা না করে কাজলশাহে করার প্রধান কারণ ছিল অপর্যাপ্ত ভূমি। কাজলশাহে হাসপাতাল নির্মাণের পর হাসপাতালের সামনে, পশ্চিম ও উত্তর পাশে অনেক খালি জায়গা ছিল যা প্রয়োজনের তাকিদে আজ আর নেই। অন্যদিকে তখনকার সিলেট জেলা বর্তমান সিলেট বিভাগের মোটামুটি মধ্যভাগে স্থাপিত হয়েছিল সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। কিন্তু বর্তমানে সিলেট জেলা হাসপাতালটি স্থাপিত হচ্ছে সিলেট জেলার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। যার পশ্চিম প্রান্তে সিলেট জেলার মাত্র ৩টি ইউনিয়ন রয়েছে। উত্তরে আছে ১টি ছোট উপজেলা কোম্পানিগঞ্জ, দক্ষিণে আছে ২টি উপজেলা বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জ। আর বাদ বাকী ৮টি উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জ এর অবস্থান পূর্বপাশে। তাই জেলার বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সুবিধার কথা বিবেচনা করা উচিত। বর্তমানে সিলেট সদর উপজেলার পূর্বপাশে বাংলাদেশের বৃহত্তম সিলেট সেনানিবাস, র‌্যাব-৯, শাহপরান থানা, বিকেএসপি সহ অনেক সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। এসবকে কেন্দ্র করে আবাসিক এলাকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা-সিলেট-তামাবিল রোড ফোর-লেনের কাজ-অচিরেই শুরু হবে। সিলেট-সুতারকান্দি রোড ফোর লেনে উন্নীত করার চিন্তা ভাবনা চলছে।

যদি সিলেট জেলা হাসপাতালের স্থান নির্বাচন করা হয় সিলেট ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম পাশে যেখানে পর্যাপ্ত খাস জমি রয়েছে। তাহলে গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর এমন কি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণের রোগীরা সহজে সিলেট-তামাবিল রোড দিয়ে সুরমা গেইট বাইপাস হয়ে এবং জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার রোগীরা সিলেট-সুতারকান্দি রোড হয়ে সিরাজউদ্দিন আহমদ চত্বর দিয়ে বাইপাস হয়ে সহজে হাসপাতালের সুবিধা নিতে পারবেন। এমনকি বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলার রোগীরাও অনেক সময় শহরের যানজট এড়াতে এদিকে আসতে পারবেন। ফলে শহরে যানজট হবে না। তাছাড়া সিলেট শহরের পূর্ব ও পূর্ব দক্ষিণ পাশের রোগীদের জন্যও যোগযোগ সহজ হবে। আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত সিলেটে প্রায়ই ভিআইপিরা শাহজালাল ও শাহপরান (র:) মাজার জিয়ারতে আসেন। তখন কোন কোন সময় শাহপরান, টিলাগড়, নাইওরপুল পয়েন্টে দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে জরুরী রোগী নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বড় কোন প্রোগ্রাম বা উরসে শাহজালালের সময় রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ঐ সময় ট্রাফিক পুলিশ ঐ রাস্তায় যান চালাচল বন্ধ করে দেয়। যান চলাচল বন্ধ করে দিলে রোগী নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হলে জরুরী প্রয়োজনে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হলো কিন্তু যেসব রোগী ঐ হাসপাতাল থেকে ঐ সময় ছাড়পত্র পাবে বা মৃত্যুমুখে পতিত হবে তাদের কী হবে ?

ধারণা করা যায় প্রকল্পের প্রথম ধাপের ব্যয় শেষ পর্যন্ত একশ কোটি টাকায় দাড়াঁবে। বাকী ৭ম তলা ভবন নির্মাণ করতে হয়ত আরো একশ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে নির্মিত জেলা হাসপাতাল নির্মাণের পূর্বে জেলাবাসির জনস্বার্থ, নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা বিবেচনা করা জরুরী। যেখানে যানজট কমানোর জন্য ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত জেলা কারাগার ইতোমধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে সেখানে তারও চেয়ে বহুগুণ বেশি নিত্য দিনের জনবহুল একটি প্রতিষ্ঠান বিকল্প রাস্তাহীন আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে তোলার পূর্বে অবিলম্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ি নির্মাণ করা উত্তম হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

নির্মাণাধীন জেলা হাসপাতালে প্রতিদিন আগত রোগীর সংখ্যা, স্বজন, দর্শনার্থী, ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে আশ পাশে স্থাপিত ফার্মেসী ইত্যাদি বিবেচনা করতে বিভিন্ন হাসপাতালের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। অন্যথায় ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো বর্তমান নেতৃত্বকে ক্ষমা করবে না। ইবনেসিনা ছাত্রাবাসের জায়গায় একটি প্যারামেডিকেল কলেজ স্থাপন করে ঐতিহ্য রক্ষা ও পরিত্যাক্ত ভূমির সদ্বহার করা যেতে পারে। এতে পরিবেশ দূষণ ও যানজট থেকে নগরবাসী পাবেন মুক্তি। প্রসুতি, হার্ট ও দগ্ধ রোগীর দ্রæত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাবে। শহরের রোগীদের জন্য ওসমানী হাসপাতাল সহ অন্যান্য সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে। শহরের বাইরের রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল প্রয়োজন নয় কী ?