সিলেটের স্বাস্থ্যসেবা: এক জটিল জট ও জন-ভোগান্তির নিরন্তর উপাখ্যান

জাকারিয়া হোসেন জোসেফ

​সিলেট অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা চিত্রটি একদিকে যেমন আশা জাগায়, তেমনি অন্যদিকে চরম হতাশাজনক। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলিতে রোগী ভোগান্তির যে ধারাবাহিক চিত্র উঠে আসে, তা কেবল সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগেরই কারণ নয়, বরং একটি দুর্বল ও অসংগঠিত স্বাস্থ্য কাঠামোর করুণ প্রতিচ্ছবি। শয্যা সংকট থেকে শুরু করে উপজেলায় চিকিৎসক শূন্যতা এবং চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়—সব মিলিয়ে সিলেটের স্বাস্থ্য খাত এক জটিল জটে আটকে আছে।

​১. শয্যা সংকট: জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় অসহায়ত্ব

​সিলেটে রোগী ভোগান্তির সবচেয়ে বড় কারণ হলো বিশেষায়িত শয্যার তীব্র অপ্রতুলতা। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক সময়েও রোগীর চাপ থাকে সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে, অনেক রোগীকে মেঝেতে বা করিডোরে চিকিৎসা নিতে হয়। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয় যখন প্রয়োজন হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) বা ডায়ালাইসিসের মতো বিশেষায়িত সেবার।

​বিশেষ করে, করোনার মতো বিপর্যয়কালে দেখা গিয়েছিল, জীবন রক্ষাকারী আইসিইউ শয্যার জন্য স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাগলের মতো ছুটছেন। এমনকি জরুরি চিকিৎসার অভাবে রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও শয্যা সীমিত, আর তার খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। একজন মুমূর্ষু রোগীকে ভর্তি না করার এই সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে।

​২. তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবায় ধস: চিকিৎসক শূন্যতার অভিশাপ

​সিলেট বিভাগের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও শোচনীয়। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মেডিক্যাল অফিসারের পদগুলোতে এক বিশাল সংখ্যক শূন্যতা বিরাজ করছে, যা আনুমানিক ৫৮ শতাংশের কাছাকাছি। মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ১৬টি পদের বিপরীতে হয়তো মাত্র দুই-তিনজন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। যা থানা শহরের অনেক হাসপাতালেই দেখা যায় ।

​এই চিকিৎসক সংকটের ফল মারাত্মক। গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের বাধ্য হয়ে জেলা সদর বা বেসরকারি ক্লিনিকমুখী হতে হচ্ছে, যা তাদের উপর আর্থিক ও শারীরিক উভয় ধরনের দুর্ভোগ চাপিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহ না থাকার অভিযোগও রয়েছে, যার ফলে তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা ভেঙেই পড়েছে।

​৩. বেসরকারি হাসপাতালের অনিয়ম ও বাণিজ্যিকীকরণ

​সরকারি হাসপাতালের ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো একরকম ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো এবং সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

​রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে কেবল বিল বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। এই বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে রোগীর মৃত্যু হলে অনেক সময়ই স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং হাসপাতাল কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ধরনের ঘটনা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসা পরিবেশকেও বিঘ্নিত করে।

​৪. অবকাঠামো নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতা: আটকে থাকা উন্নয়ন

​সিলেটে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়নও দীর্ঘসূত্রিতার শিকার। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল বা বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও তা বছরের পর বছর ধরে চালু করা যায়নি, মূলত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা জনবল সংকটের কারণ দেখিয়ে। বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল না থাকায় সিলেট অঞ্চলের শিশুরা চিকিৎসার জন্য ওসমানী হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল, যেখানে অনেক সময় এক শয্যায় একাধিক শিশুকে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা ও উদ্বোধন হলেও বাস্তবায়নের এই দীর্ঘসূত্রিতা সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

​৫. সমাধান ও ভবিষ্যতের পথ

​সিলেটের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ভোগান্তির বৃত্ত থেকে বের করে আনতে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।

​তৃণমূলে জনবল নিশ্চিতকরণ: অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে শূন্য পদে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করে তাদের গ্রামে থাকতে উৎসাহিত করতে হবে।

​বিশেষায়িত শয্যা বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা: ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্রুত আইসিইউ/সিসিইউ শয্যা বাড়াতে হবে এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবল নিশ্চিত করতে হবে।

​বেসরকারি হাসপাতালের তদারকি: বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সেবার মান ও ফি নিয়মিত তদারকি করতে হবে। অযৌক্তিক বিল বা হয়রানির ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

​চালু করতে হবে নির্মিত অবকাঠামো: দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় থাকা জেলা হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য অবকাঠামো দ্রুত জনস্বার্থে চালু করতে হবে।

​রোগী-সেবা দানকারী সুসম্পর্ক: চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘর্ষ এড়াতে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

​সিলেট শুধু একটি বিভাগীয় শহর নয়, এটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র। এই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কেবল একটি প্রশাসনিক দায়িত্বই নয়, এটি মানবিক কর্তব্যও বটে। ভোগান্তির এই অবসান ঘটাতে সরকার ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের জরুরি ও দৃঢ় পদক্ষেপই একমাত্র কাম্য।

 

লেখকঃ বার্তা সম্পাদক

দৈনিক সিলেটের দিনরাত