তোকে বিদায় বলতে আমার বয়েই গেছে… তুই কে?

 

মাসুম রেজা

এই ছবিটা যেখানে দাঁড়িয়ে তোলা, শিল্পকলার সম্মুখ চত্বরের ঠিক সেখানেই আজ নিশাতের নিথর দেহটা রাখা হয়েছিলো। নিশাতের ঠোঁটে এরকম হাসি লেগে ছিলো কিনা আমি দেখতে পারিনি। ফলে আমিও ঠোঁট চেপে হাসতে পারিনি। নিশাত আমার বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের মূল উপজীব্য ছিলো ঝগড়া। আমরা দুজনে এত এত ঝগড়া করেছি, তার কোনো সীমা পরিসীমা নাই। এই ঝগড়া দিয়েই আমরা ছত্রিশ বছরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব উদযাপন করেছি।

আমি নিশাতকে সবসময় বলতাম, ‘লাইনে আয় বন্ধু’ ও বলতো আমি ঠিক লাইনেই আছি। আমি বলতাম, তুই কারো নাটক দেখে খারাপ লাগলে তার মুখের উপর বলে দিস তোর ভালো লাগেনি, এটা কী ঠিক? ও বলতো এটাই ঠিক। বলতাম শিল্পকলায়, গ্রুপ থিয়েটারে কে কী করছে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের নাটকের কাজটা কর। ও বলতো, ‘আমি যা করছি তা নাটকেরই কাজ। এই কাজ না করলে তোরা নাটকটা ঠিক মতো করতে পারবি না।’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে মাথা ঘামাচ্ছিস ঘামা কিন্তু এই নিয়ে রাস্তায় নামিস না’। তার সোজাসাপটা বক্তব্য, ‘রাস্তাতো নামার জন্যেই বন্ধু। রাস্তায় না নামলে কিছু হবে না।’ আমি বলতাম, শরীরের যত্ন নে ছেমড়ি ও বলতো শরীরের যত্ন আমি নেবো কেন? ট্যাক্স দিয়া ডাক্তার বানাইছি। ডাক্তাররা নেবে.. বলতাম তুইতো ডাক্তারের কাছেও যাস না.. ও বলতো যখন দরকার পড়বে যাবো..

নিশাত আমার সেই বন্ধু যে সেই ১৯৯০-৯১ সালের দিকে আমার পকেটে কড়কড়া একটা বিশ টাকার নোট ঢুকিয়ে দিয়ে বলতো টিএসসিতে যাওয়ার বাসভাড়া। আমি আর তপন সেই টাকা বাঁচাতাম বাসে না উঠে চামেলিবাগ থেকে পায়ে হেঁটে টিএসসিতে গিয়ে; যাতে টিএসসিতে গিয়ে দলের অন্যান্যদের সাথে চা সিঙ্গাড়া খাওয়া যায়। গত কয়েকমাস ধরে আমার জলবাসর নাটকের মহড়া চলছে। নিশাত আমাকে বলেছিলো, বন্ধু এই নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারটা আমি দেখবো। তুমি শুধু ব্লকিংটা করে দাও। ব্লকিং শেষ হলে, নিশাত অভিনয়ের কাজ শুরু করলো। এই সময়ে ও ডাক্তারের কাছে গিয়ে অনেকগুলো টেস্ট-ঠেস্ট করিয়ে বললো দোস্ত আমিতো ভাবছিলাম আমার পার্টসপুর্টস সব শ্যাষ। কিন্তু রিপোর্টতো ভালো। কোনো ঝামেলা নাই। আমি বললাম, তাইলে ধরে নে তুই সেকেন্ড লাইফ পেলি। এবার শরীরের যত্ন নে। ও আমাকে বললো, থাম আগে তোর নাটকটা জাত করে নেই। শুরু করলো জলবাসরের অভিনয় নিয়ে পারফরমারদের সাথে কাজ। কী অমানুষিক পরিশ্রম করলো আর করালো। ওর কাজের কোয়ালিটি দেখে মুগ্ধ হলাম। কী সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ডিটেইল দেখিয়ে দিলো প্রতিটা চরিত্রের। বন্ধু আমার ‘দা মোস্ট ট্যালেন্টেড পারফরমার অফ দা কান্ট্রি’।

জলবাসর-এর লাইটের ডিজাইন করছে টিটু। কিন্তু আমি ওকে বলেছিলাম, তুইতো সু-লাইট ডিজাইনার হিসেবেও খ্যাত। তুই টিটুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিস। গতকাল সন্ধ্যেই দেখলাম টিটুর সাথে বসে লাইটের পুরোটা ডিজাইন ফাইনাল করলো। জলবাসর-এর একটা দৃশ্য কম্পোজ করা বাকি ছিলো। সেটাও গতকাল দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে নির্দেশনা দিয়ে শেষ করলো। জলবাসর-এ ওর কাজ গতকাল শেষ হয়েছিলো। কাজগুলো শেষ করে পোস্টার লিফলেট প্রকাশনা ডিজাইন নিয়ে বসলাম। সেটাও ফাইনাল করে দিলো। মাহফুজকে ফোন দিয়ে বলে দিলো ‘পোস্টারটা ছেপে ফেল বাপ’.. ফোল্ডারে সবার বিষয়ে কথা থাকছে কিন্তু ও কোনো লেখা দেবে না। আমি বললাম তোর লেখা ব্রুশিয়ারে না থাকলে আমি সেই ব্রুশিয়ার হাতে নেবো না। ও বললো দেখ আমি হাত নড়াতে চড়াতে পারছি না, তুই যদি লিখে দিস তবে আমি সেটা আমার নামে ছাপবো.. তবে আমাকে দেখিয়ে নিবি কিন্তু। আমি একটা লেখার মুসাবিদা ওকে দেখালাম। মনে মনে ভয়ে ছিলাম যে একটা জায়গায় হয়তো আপত্তি করবে। আমি লিখেছিলাম.. ‘শিল্পকলার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এই নাটকের মহড়া থেকে শুরু করে সবকিছুতে আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্যে.. লাইনটা পড়ে নিজে নিজেই মাথা নাড়লো। আমি এতদিন ভাবতাম শিল্পকলার প্রতি ওর খুব রাগ। এই লাইনটা ও রাখবে না। কিন্তু দেখলাম ও বললো শিল্পকলার কথাটা লিখে ভালো করেছিস। সত্যিই শিল্পকলা এই নাটকে আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। লাকী ভাই আপনি হয়তো নিশাতকে ভুল বুঝে থাকতে পারেন। নিশাত কিন্তু প্রাপ্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কখনো কার্পণ্য করেনি। সব কাজ শেষ করে নিশাত ওর বোনের বাড়ি গুলশানে গেলো আর আমরা ফিরে এলাম বাড়ি। কী আশ্চর্য বিষয় আমি নিশাতের কাছ থেকে বিদায় নিতে দিব্যি ভুলে গেলাম। অন্যান্য দিনের মতো নিশাতও চিৎকার করে বললো না; কিরে, না বলেই চলে যাচ্ছিস যে.. পছন্দ হয় না, না? শেলী ভোলা গিয়েছিলো, বাড়িতে আমি একা থাকতে পারি না তাই আমার ছোটভাইকে সাথে করে এনেছিলাম। দুজনে কিছুক্ষণ গালগল্প করে নিজ নিজ ঘরে ঘুমাতে গেছি এমন সময় বাবুর ফোন, নিশাত আপা ইজ নো মোর…

যেখানে দাঁড়িয়ে রোজ তোর কাছ থেকে বিদায় নিতাম.. আজ তোকে সেখানে আনা হয়েছিলো.. তুই ছিলি, আমিও ছিলাম.. কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ একজন ছিলো না.. বাচ্চুভাই, মামুনভাই, আতা ভাই, নুর ভাই, যাকের ভাই, সারা আপা, শিমুল আপা, কেরামত দা.. লাভলু, আসাদ ভাই আরো কত কত মানুষ.. কত কত মানুষ.. সবাই বললো; নিশাতের কন্ঠে দ্রোহ ছিলো, নিশাত আপসহীন ছিলো, নিশাত যা বলার মুখের উপর বলে দিতো.. সবাই মিলে তোর এই গুণ গুলোর অনিঃশেষ প্রশংসা করলো.. আমি বুঝলাম আমিই ভুল ছিলাম.. তুই সঠিক ছিলি.. তুই যা করে গেছিস তার জন্যেই তুই ‘তুই’ হয়েছিস.. দোস্তো আসলে তোর ঘরানাটা আমার বোঝারই ক্ষমতা ছিলো না.. আলগাই তোর সাথে চিল্লাতাম.. কফিনের ভিতরে সাদা কাপড়ে নিজেকে আবৃত করে এসে শিল্পকলার সম্মুখ চত্বরে তুই আজ যা দেখিয়ে দিয়ে গেলি আমার ভাষায় তা হলো ‘দি মোস্ট সেলিব্রেটেড ডেথ অফ এ ‘ননসেলিব্রিটি’ পারফর্মার’.. বিদায় বলবো না.. তোকে বিদায় বলতে আমার বয়েই গেছে.. তুই কে?