বাবার জীবনের পথ ছিল সংগ্রামী

 

কয়েস গাজী:

ছোটবড় সব নেতাই ছিলেন বাবার আপন। কারো সাথে কখনো রুঢ় আচরণ করতে দেখিনি। বরং আমাদের শাসন করতেন। কারণরাজনৈতিক কারণে পড়ালেখা করা কষ্টসাধ্য ছিল আমাদের। বাবা বাইরে নেতাকর্মী নিয়ে ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকতেন। মা ঘরে ব্যস্ত থাকতেন আমাদের দেখাশুনা নিয়ে।

বাবার রাজনৈতিক জীবন বাজী রেখে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করে যেতেন। আমি বাবার সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলাম। আমার রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন বাবা দেওয়ান ফরিদ গাজী। আমাকে যেকোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। আমিও সভা মিছিল সবজায়গায় অংশ নিতাম ।

আমার জীবনে ছোট একটি ঘটনা ১৯৬৬ সালের। বাবা দেওয়ান ফরিদ গাজী ও আসদ্দর আলী চাচা গ্রেফতার হয়েছিলেন। আয়ুবখানকে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ও আগরতলা ষরযন্ত্র মামলায় কারাগারে ছিলেন প্রায় মাস ৬ মাস। তারা সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পুলিশ প্রহড়ায় ২-৩ মাস ছিলেন। সেসময় আমি ও জরু ভাই বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। একদিন আমি আব্বার সাথে হাসপাতালে থাকার বায়না ধরলাম। আমাদের নিজস্ব রিকশা চালক আসদ্দর আলী চাচা আমাকে ভয় দেখালেন। পুলিশ নিয়ে যাবে তোমাকে। আব্বা আমাকে কাছে রাখতে মৌন সম্মতি জানালেন। আব্বা বললেন সন্ধ্যার পর চলে যাবে। জরু ভাই চলে গেলো বাসায়। রাতে একজন সাদাপোশাকধারী দাড়ীওয়ালা পুলিশ আসলেন। তিনি আমাকে বাসায় চলে যাবার জন্য বললেন। কিন্তু আব্বা সেদিন আর আসতে দিলেননা। রাত হয়ে গেছে বলে থেকে গেলাম। আমি আব্বার সাথে বেডে বসে গল্প করতে ছিলাম। সবার কথা আব্বা জিজ্ঞেস করলেন। সবার পড়াশুনা কেমন চলছে জানতে চাইলেন। আমার বুঝমত উত্তর দিলাম। আমাকে বলতেন পড়ালেখা না করলে মানুষ হওয়া যায়না। আসদ্দর আলী চাচার বাসা থেকে সকালের নাস্তা আসলো। তিনজনই নাস্তা করলাম। আব্বা ও আসদ্দর আলী চাচা পেপার নিয়ে বসলেন ইত্তেফাক আরো একটি দৈনিক পেপার। নামটা মনে পরছেনা তবে যুগভেরী ছিলো সাথে। সকালবেলা ডাক্তার ওয়ার্ড ভিজিট করলেন। আব্বা ও আসদ্দর আলী চাচার সাথে কী কী আলাপ করলেন ২জন ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারিনি। তখন বেলা ১২টা। জেল সুপার আসলেন। সাথে ওই দাড়িওয়ালা পুলিশ। নামটি মনে পরছেনা। আমি আব্বার ও আসদ্দর চাচার দুপুরের খাবার খাওয়ার পর জরু ভাইয়ের সাথে বাসায় চলে আসি। এভাবে আব্বা ও আসদ্দর চাচার মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত আমি আরো ৩-৪ দিন হাসপাতালে থেকেছি। পরে জেলে নিয়ে যায়। নাসিরউদ্দিন ডিএসপি গ্রেফতার করেছিলেন আব্বাকে কুয়ারপার থেকে।

 

সকালবেলা চলে গেলাম কতোয়ালী থানায় আব্বকে দেখতে। তখন ওসি সাহেব ছিলেন মোঃ আলী । খুব মোটা করে লোকটি। যার সামনে কেউ যেতে ভয়ে কাঁপতেন। একসময় তিনি টাউন ইনসপেক্টর ছিলেন। আমরা থানায় যাবার পর আমাদের আদর করে খাবার দিলেন। বিস্কুট আর চা ছিল। আমি চায়ের পাগল ছিলাম। চা খেলাম বিস্কুট ভিজিয়ে। আব্বার পাশে বসে। আব্বাসহ আরো যারা ছিলেন তখন তারা সকলেই সেলের বাইরে বসে গল্প করছেন। আব্বা সহ সবাইকে কোর্টে নিয়ে যাবে হাজিরা দিতে। এরপর জেলে প্রেরণ। পরের দিন আবার আম্মা, আমি ও নানু আব্বাকে দেখতে গেলাম জেলে। জেলসুপার দেখা করার সুযোগ দিলেন। দেখা হলো আমাদের সকলের। কথা হলো। আব্বা আম্মাকে যা যা বলার বলে দিয়েছেন।

ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া তেমন কেউ আমাদের পাশে আসেননি ভয়ে। আর যারা খবর রাখতেন তারা লোক মারফত খবর নিতেন আমাদের। দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে বাবার সংগ্রামের পথচলা। তখন ফারুক লেঘারী এডিসি সিলেটের ও প্রশাসক সিলেট পৌরসভার। আমার বাবাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। তখন আমাদে গাড়ী ছিল ওইলিস জীপ। কনা মিয়া ড্রাইভার ও তারা মিয়া ড্রাইভার ১৯৭০ সালের নির্বচন পর্যন্ত জীপ গাড়ী চালাতেন। আমি বাবার সাথে সবসময় থাকতাম। প্রত্যেক নির্বাচনী সভায়। বাবাকে যারা সর্বক্ষণ সাহায্য সহযোগিতা করতেন তারা হলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী ব্যারিস্টার, হাজী মরম আলী, হাজী রাসিদ আলী, ইসমাইল মিয়া, ন্যাপ নেতা আবদুল হামিদ চাচা, পীর হাবিবুর রহমান চাচা সবাই ছিলেন আমার বাবার আপন জন। ৭০ সালের নির্বাচনে তারাই সব কিছুই পরিচালনা করেন। এবং জাতীয়পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ঢাকায় গেলাম বাবার সাথে বিমানে সিলেট থেকে। আমার হাফ মূল্যে টিকিট ছিল। ঢাকা তখন থমথমে অবস্থা। মিছিল আর মিছিল। ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় সকলেই। পরের দিন চলে আসি। আব্বা ও বঙ্গবন্ধু সহ সকল জাতীয় পরিষদ ও এমসিএ সহ সদস্যবৃন্দ এক জরুরি সভা করেন। সেখানে কি আলোচনা হলো আমি আর খবর নেইনি। ছোট ছিলাম।

আমি সিলেট এসে দেখি আমাদের শেখঘাটের বাসায় লোকে লোকারণ্য।
পরের দিন মিছিল আর মিছিল। রেডিও স্টেশন থেকে এসে আমার বাবার বক্তব্য ধারন করে নিয়ে যান সিলেট বেতার কেন্দ্র।