আমার বাবা ফরিদ গাজীকে যেভাবে দেখেছি

কয়েস গাজী:

বাবার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিলো বৃহত্তর সিলেটবাসীর কথা ও চিন্তাধারায়। ১ম জীবনে ছিলো লেখা পড়া। জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও সামন্তবাদ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশবাদ বিরোধীসহ সকল ক্ষেত্রেই আমার বাবা সংগ্রাম করেছেন।

ছাত্র জীবনে অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে মা ভাইবোন ছেড়ে মাদ্রাসায় লেখা পড়া শুরু করেন। শিক্ষা জীবন শুরু হয় মৌলভীবাজারে একটি মাদ্রাসায়। এখানে অধ্যায়ন করেন ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায়। ৮-ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করে পরে সিলেট রসময় মেমোরিয়েল হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে এমসি কলেজে ভর্তী হয়ে ইনটার পাশ করেন। অল্প বয়সেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে নিজে রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠাতা লাভ করেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল আমার বাবার প্রথম মাইল ফলক। ১৯৪২ সাল থেকেই রাজনীতির হাতেখড়ি যাদের সংস্পর্শে তারাই ছিলেন তৎকালীন অভিজাত পরিবারের সন্তান। তারাই দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবকে পূর্ন আত্মবিশ্বাসী করে তুলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে।

দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন হয়রত শাহজালাল(রঃ) এর অন্যতম ধর্মপ্রচারক ও সহযোদ্ধা হযরত শাহ তাজউদ্দীন কোরেশী সাহেবের ১৭ তম বংশধর। ১৯২৪ সালের ১লা মার্চ দিনারপুর পরগনা দেবপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । পিতা মরহুম দেওয়ান হামিদ গাজী ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে মৃত্যুবরণ করেন।

এমসি কলেজ থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তিনি অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট কংগ্রেসের সাথে জড়িয়ে পরেন। মুসলিম লীগের অঙ্গ সংগঠন আসাম মুসলীম ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে দেওয়ান ফরিদ গাজী আসাম প্রাদেশিক শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসময়ে আরো ছিলেন মরহুম তছদ্দুক আহমদ চৌধুরী, এটিএম মাসুদ, পীর হাবিবুর রহমান আবদুস সামাদ আজাদসহ আরো অনেকে। তখন মৌলানা ভাসানীর ডাকে আসাম বাঙ্গাল খেদাও অভিযানের প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সকলের গাজী সাহেবের প্রতিবাদী রাজনৈতিক জীবনের শুরু।

১৯৪৬ সালে নয়াসড়ক মসজিদে সিলেটের সংগ্রামী মুসলিম ছাত্রজনতা ও জমিয়তে উলাময়ে হিন্দের সংঘর্ষ হলে তখনকার ছাত্র নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী মাথায় আঘাত পেয়ে আহত হন।

১৯৪৭ সালে গণভোটের জন্য আ্বদুল হাফিজ সাহেবের একটি চিটি নিয়ে যান আসাম প্রাদেশিক সরকারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী স্যার সাদুল্লাহ সাহেবের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী বিশহাজার টাকা দিলে তিনি আসাম থেকে টাকা ও চিঠি নিয়ে জীবনবাজী রেখে কঠিন সময় অতিক্রম করে হাফিজ সাহেবের কাছে টাকা ও চিঠি পৌঁছে দেন। কারণ পথিমধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন।

বাবার জীবন যেভাবে আমরা পেয়েছিলাম

বাবার জীবনের একটি ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের গণভোটে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করেন। তখন বখতিয়ার বিবি বিদ্যালয়ে মুসলিম লীগ ও মুসলীম ছাত্রফেডারেশনে নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৪৭সালের ৬ ও ৭ জুলাই গনভোটে জয়লাভ করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় সিলেট। তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতৃবৃন্দ সিলেট আসেন। শেখ মুজিবুর রহমান খোঁজ খবর নেন দেওয়ান ফরিদ গাজীর পরিবারের। তখন শেখ সাহেব বললেন আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। ভাল বংশের মানুষ হয়ে আপনি কেন সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে আসলেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী জানালেন, আমারও আপনাকে ভালো লেগেছে। শেখ সাহেব বললেন আসুন আমার সাথে আমরা একসাথে রাজনৈতিক ভাবে মনের মিল রেখে আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি করি। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাথে যাত্রা। দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেব থাকতেন শেখ সাহেবের সাথে।

বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনা ছিলো সূদূরপ্রসারী। তিনি জেলা ভিত্তিক একজন নেতা তৈরি করে হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন।

আমার বাবা দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন একজন কর্মী বান্ধব নেতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুজিব নগর সরকারের ৪ ও ৫ নং সেক্টরের প্রশাসনিক চেয়ারম্যান ও বেসামরিক উপদেষ্টা। বাবার সাথে আমি ছোট বেলা থেকেই বাবার হাত ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভায় যেতাম। সেসময় ১৯৬৮ থেকে ৭১ সালের প্রথম দিকে বিভিন্ন স্কুলে মিছিল যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস কেটেছে অনিশ্চয়তার মধ্য। গেরিলা যুদ্ধাদের বিশেষ করে দেখতাম কিভাবে তারা যুদ্ধ করে ফিরে আসতেন। দেশ স্বাধীন হলো ১৮ ডিসেম্বর
৭১ আমরা করিম গন্জ থেকে ফিরে আসি মাতৃভূমিতে। শেখঘাটের বাসায়।২২ ডিসেম্বরে আমি হ্যালিকাপ্টারে কারে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগছি, আমার পিতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, কর্নেল এমএ রব সহ আরো কয়কজন একসাথে ঢাকা যাই। ঢাকায় গিয়ে রাতেই বাবার সাথে কয়েক জায়গায় গিয়েছিলাম। সেখানে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অনকের সাথে দেখা হয়। ২দিন পর সিলেট ফিরে আসি।

বাংলাদেশের উত্তর- পূর্বান্চলীয় জেলা কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগন্জ, মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট এসে পৌছাই ভোরবেলা। সে ইতিহাস ছিলো ভিন্ন।

লেখক: সহসভাপতি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ