আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? মেডিকেলীয় ব্যাখ্যা

 

ডা. সাঈদ এনাম

মাঝেমধ্যে দৃষ্টিশক্তিহীন একজন নারী আসেন মাথাব্যথা এবং এনজাইটি নিয়ে। তার মাথাব্যথা বা এনজাইটির ঔষধ দেবার পর খানিকটা সময় তার সঙ্গে কফি খাওয়া হয়। তার এনজাইটি ও তার দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে আলাপ করি। বিশ্লেষণ করি, মানুষের স্বপ্ন বিষয়ক কৌতুহল থেকে। এতে যারপরনাই খুশি হন ভদ্র মহিলা।

অন্ধ তবুও স্বপ্ন দেখেন। তার ভাইবোনকে দেখেন, মা বাবাকে দেখেন। স্বামীকে তেমন একটা দেখেননি। তার যখন বিয়ে হয় তখন তিনি চোখে দেখতেন না। স্বপ্নে তার এক বড় বোনকে প্রায়ই দেখেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর সময় তিনি তার পাশে সার্বক্ষণিক ছিলেন। এখন ইউরোপে থাকেন।

আসলে তিনি তাদের বেশি দেখেন যারা অসুস্থতার সময় বা তার আগে পরে পাশে ছিলেন। দৃষ্টিশক্তি হারান কৈশোরে। এখন তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। দুই ছেলেমেয়ে। তারা ইউরোপে খালার কাছে। তিনি একবার ইউরোপ ভ্রমণ করেও এসেছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে স্বপ্ন রহস্যময় মুহূর্ত। স্বপ্ন নিয়ে আবহমান কাল ধরে বৈজ্ঞানিক দার্শনিক গবেষণা করে আসছেন। কিন্তু স্বপ্ন আজো রহস্যময় রয়ে গেছে সবার কাছে। আমি মনে করি রহস্যের উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা চলতে থাকবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যুগ যুগান্তর।

আজ থেকে কয়েক হাজার পূর্বে রাজাধিরাজদের কাছে স্বপ্ন ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজা স্বপ্নে পেয়েছেন সিদ্ধান্ত সুতরাং আর কোনো কথা নেই। খ্রিস্টপূর্বে ৩১০০ অব্দে মেসোপটোমিয়ান সভ্যতায় সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের অনেক সিদ্ধান্ত তাদের স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে হতো। রোমান সম্রাটগনও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তাদের ঘুমের মধ্যে দেখা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ‘স্বপ্ন’ পেশ করতেন সিনেটে। আর তা নিয়ে গবেষণায় বসতেন, স্বপ্ন বিশারদরা।

অবশেষে সে আলোকেই হতো সিদ্ধান্ত। তারা মনে করতেন স্বপ্ন সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আসা কোন দিক নির্দেশনা। এমনকি অনেক সম্রাট সম্রাজ্ঞী তাদের সামরিক বাহিনীর অনেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্রেফ স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করেই। ফলে যুদ্ধে গিয়ে, হয় নতুন দেশ জয় করে বীরের বেশে জয়মাল্য পরে ফিরেছেন। নতুবা হেরে গিয়ে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে করেছেন আত্মহত্যা।

বর্তমান আধুনিক সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট দের মতে স্বপ্ন তেমন একটা আহামরি কিছুই নয়। রাজ্য শাসন করতে গয়ে নীতিনির্ধারণী কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এর কোনো গুরুত্ব আদৌ আছে বলে কেউ মনে করেন না। বরং এতে হিতে-বিপরীত হবার আশংকা থেকে যায়।

স্বপ্ন আসলে কী?

অনেক বন্ধুবান্ধব আছেন যারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, ‘তারা স্বপ্ন দেখেন না’। আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। তারা স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু ভুলে যান, বা মনে করতে পারেন না। স্বপ্ন আসলে কী? স্বপ্ন তেমন কিছুই নয়। স্বপ্ন, অবচেতন মনের প্রযোজনায় ‘বর্তমান’, ‘নিকট অতীত’ ও ‘দূর অতীতে’ ঘটে যাওয়া ঘটনা ও তার অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত একটি ‘ছোট নাটিকা’ বা ‘সেগমেন্ট’ বলা চলে।

দুই.

স্বপ্নের কিছু চাঞ্চল্যকর বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা বেশিরভাগ স্বপ্ন দেখি রেপিড আই মুভমেন্ট (REM- SLEEP) স্লিপ পর্বে। রেপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ কী?

আমাদের ঘুমের দুটি স্তর। ‘চক্ষু আন্দোলন’ পর্ব (রেপিড আই মুভমেন্ট -REM) এবং চক্ষু স্থীর পর্ব (NON REM)। ঘুমের মধ্যে আমাদের চোখ দুটো কখনো আন্দোলিত বা কাঁপতে থাকে আবার কখনো স্থির থাকে। তাই ঘুমের এমন নাম। বেশিরভাগ স্বপ্ন আমরা দেখি চক্ষু আন্দোলন পর্ব ঘুমের সময়। আর ঘুম থেকে জেগে উঠার অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সিংহভাগ স্বপ্নই ভুলে যাই। কী স্বপ্ন দেখলাম হুবহু মনে করতে পারি না, এটা স্বাভাবিক ঘটনা।

স্বপ্নের মধ্যে ব্রেইন নতুন করে কারো কোন ইমেজ অবয়ব বা চেহারা তৈরি করতে পারে না। সে ক্ষমতা ব্রেইনের নেই। অতীতে দেখা চেহারা অবয়বেই প্রিয়জনকে দেখি। অনেক আগে যারা মা,বাবাকে হারিয়েছেন তারা তাদের মা বাবা কে ঠিক সেই অবয়বেই দেখেন, যখন তারা মারা গিয়েছিলেন।

অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখেন?

হ্যাঁ, অন্ধ মানুষও স্বপ্ন দেখেন। এমনকি যারা জন্মান্ধ তারাও স্বপ্ন দেখেন। তবে তাদের সে স্বপ্নে কারো চেহারা বা ছবি থাকে না। আর যারা জন্মের অনেক পর দৃষ্টিশক্তি হারান তাদের স্বপ্নগুলোও আমাদের মতনই। আমার দৃষ্টিশক্তিহীন রোগী ও এমন। তিনি তার মা বাবা ভাইবোন কে সেই চল্লিশ বছর আগেকার অবয়বে দেখেন।

কাদের আমরা স্বপ্নে দেখি?

স্বপ্নে আমরা পরিচিত মানুষগুলোকেই দেখি। দেখি পরিচিত চেহারায়। দৈবাৎ কেউ স্বপ্নে যদি দেখেন পাশে শুয়ে থাকা ‘স্বামী বা স্ত্রী’ থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছেন, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, আসলে সেটা ব্রেইনের একটা ছোট ভুল। সে মেমোরি সেন্টার থেকে দৃশ্যগুলো/ অবয়বগুলো এনে জোড়া দিতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় একজনের অবয়বের মধ্যে আরেকজনের অবয়ব লেপ্টে দিয়েছে বে-খেয়ালে।

আবার এও হতে পারে বয়স্ক অবয়ব হিসেবে ব্রেইন যাকে প্রিয়জন বলে উপস্থাপন করেছে, সেই অবয়বটা আমাদের দূর অতীতে দেখা কেউ, যা ব্রেইনের মেমোরি সেন্টারে সযত্নে তুলে রাখা ছিল। ব্রেইন ‘মেমোরি’ থেকেই তা তুলে এনেছে। মনে করতে পারছেন, ঠিক কে সে। তবে ভালো করলে মনে করার চেষ্টা করলে পরে হয়তো সেই বয়স্ক অবয়বের আসল মানুষকে খুঁজে বের করা যাবে।

তিন.

আমাদের বেশিরভাগ স্বপ্ন লাল, নীল-বর্ণীল। ১৯৫০ সালের আগে বিজ্ঞানীরা বেশীরভাগ স্বপ্ন ধরে নিতেন সাদাকালো। ষাটের দশক থেকে সে ধারণা পালটে যেতে শুরু কিরে। এর একটা কারণ হতে পারে ষাটের দশকের পর থেকে টিভি সিনেমায় -নাটক চলচ্চিত্রে সাদাকালো পরিবর্তে রঙিন ছবির ঝলমল দৃশ্যের অবতারনা।

স্বপ্নে বিপরীত বিষয়ই আমরা বেশি দেখি। যেমন পরীক্ষায় ফেল দিয়েছি। লিখতে পারছি না, কমন পড়েনি বা পরীক্ষক খাতা টেনে নিয়ে গিয়েছেন। কিংবা ভালোবাসার মানুষ অন্যের হাত ধরে টা-টা বাই-বাই বলে চলে যাচ্ছে। আপনি তার পেছনে পেছনে ‘নাইট রাইডার’ হয়ে ‘না -যেও না…’ বলে দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না, আপনার পা মাটিতে লেপ্টে যাচ্ছে।

অথবা স্বপ্নে দেখছেন বাঘ ভাল্লুক আপনাকে তাড়া করছে আপনি হাউমাউ করে কাঁদছেন, চেঁচামেচি মরছেন, কিন্তু পা চলছে না। বাঘ এসে ঘাড়টা যেনো মটকিয়ে চলে গেল। এক পেশেন্ট দেখেছিলাম, সে স্বপ্নে প্রায়ই দেখতো বাঘ বা ভাল্লুককে থাপড়াচ্ছে।

অথচ বাস্তবে সব থাপ্পড় যেতো পাশে শুয়ে থাকা বউয়ের নাক মুখে। এ নিয়ে তাদের সংসার যায় যায়।

পশুপাখিও স্বপ্ন দেখে। আপনার প্রিয় বিড়ালটি ঘুমিয়ে থাকলে দেখবেন তার চোখ নাড়াচাড়া করছে কিংবা কানটা নড়ছে। আসলে সেটা তার স্বপ্ন।

বাহ্যিক শব্দ বা পরিবেশ আমাদের স্বপ্নকে প্রভাবিত করে।

যেমন ধরুন আপনার ছোটভাই পাশের রুমে গিটার বাজাচ্ছে, আর আপনি স্বপ্নে দেখছেন, আছেন কোন এক লাইভ কনসার্টে, হাতে গিটার আদতে কোল বালিশ।

কিংবা হয়তো আপনি স্বপ্নে দেখছেন আপনি ‘আইএসআইএস’ যোগ দিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর হয়ে মুহুর্মুহু মিসাইল ছুঁড়ছেন মিসরে বা সিরিয়ার মরুভূমিতে। আদতে সেটা সে রাতের ‘শিলাবৃষ্টি’র শব্দ, যা আপনার টিনের চালকে প্রায় ফুটো করে দিচ্ছিলো।

তরুণ- তরুণীরা প্রায়ই স্বপ্নে দেখেন তারা তাদের প্রিয় নায়ক বা নায়িকাদের সঙ্গে গালগল্প সেরে নিচ্ছেন নিরালায় কিংবা কোন শত্রুর সঙ্গে গলাগলি করছেন। বাস্তবে সেটা জড়িয়ে ধরা তোশক বা কোল বালিশ।

স্বপ্নের মধ্যে আমাদের হাত পা অবশ থাকে, নাড়াতে পারি না। তাই আমরা স্বপ্নে প্রায়ই দৌড়াতে বা হাটতে দেখতে পারি না।

পুরুষদের স্বপ্নে বেশিরভাগ চরিত্রই থাকে পুরুষ, নারী চরিত্র থাকে কম। কিন্তু নারীদের স্বপ্নে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার ফিফটি-ফিফটি। আর পুরুষদের স্বপ্ন একটু ভয়ানক হয়, নারীদের তেমন একটা নয়।

স্বপ্ন যেহেতু আপনার বর্তমান অতীত অভিজ্ঞতা, আপনার চিন্তা-চেতনা, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি তাই স্বপ্নকে খুব একটা সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।