১৫ আগস্টের ট্রাজেডি আজো কাঁদায় কয়েস গাজীকে

 

মনজুরুল আমিন দোয়েল

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপিত গাজী মোহাম্মদ জাফর সাদেক কয়েস গাজী হলেন সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর পুত্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হন দেওয়ান ফরিদ গাজী। রাজধানীর মন্ত্রী পাড়ায় স্বপরিবারে বসবাস করতে তিনি। কয়েস গাজীও সেখানে বসবাস করতেন। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম ট্রাজেডির বর্নণা করেছেন দেওয়ান কয়েস গাজী। সেই বর্ণনা তুলে ধরা হলো এখানে।

‘আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ঢাকার মন্ত্রী পাড়ায় বসবাস করি। বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের বাণিজ্যমন্ত্রী। আমাদের ভাইবোনের রুটিন ছিল ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নেওয়া। প্রস্তুিতির প্রথস পর্ব ছিল নামাজ পড়া। তারপর সকালের নাস্তা। স্কুলের পোষাক পরিধান করে প্রস্তুতি নেওয়া স্কুলে যাওয়ার। সকাল সাতটার মধ্যে আমরা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম। কিন্তু ১৫ আগস্টের সকাল ছিল অত্যন্তু হৃদয়দিারক।’

‘ওই দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে গুলির শব্দ শুনে। গুলি শব্দ ছিল বিরতিহীন। আতঙ্কিত অবস্থায় ঘুম ছাড়ে। মুর্হমূহ গুলির শব্দ আমাদের পরিবারের সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলে। আমরা ঘরের ভেতর পায়াচারী করতে থাকি। এক সময় আমি এবং আমার বড় ভাই মিলাদ গাজী (বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য) বাসার প্রধান ফটকে যাই। গিয়ে দেখতে পাই প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। পুলিশ বাইরে দাড়িয়ে আছেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না। পুলিশও কিছু বলছে না। বাসার বাইরেও যেতে পারছি না। গুলির শব্দও থামছে না। উর্দি পড়া লোকজন টহল দিচ্ছে। একসময় জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে গুলির তান্ডব চালাচ্ছে উর্দিওয়ালারা। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম ওই বাসার সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। বেঁচে নেই আবদুর রবও।

গেটে তালা লাগানো থাকায় কেউ বের হতে পারছি না। বাবা দেওয়ান ফরিদ গাজী বঙ্গবভনে ফোন করেন। কোনো উত্তর নেই। বাবা আরো বেশ কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেন। কিন্তু উত্তর নেই। আমি আর বড় ভাই বারবার গেটে যাচ্ছি। কিন্তু তালা লাগানো। দেখলাম একজন সাংবাদিক মোটর সাইকেলে করে যাচ্ছেন। তার উপর গুলি করা হলো। মাটিতে পড়ে গেলেন ওই সাংবাদিক। উর্দিওয়ালারা তাকে বেদম মারপিট করে ড্রেনে ফেলে দিলেন। একসময় আমাদের বাসার গেটের তালা খুলে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন পোষাকধারী আর্মি আমাদের বাসায় প্রবেশ করলেন। তারা ফরমান জারি করলেন, কেউ যাতে ঘর থেকে বের না হই। নজরুল ইসলামের সাথে বাবার কথা হয় ফোনে। তিনি বললেন একটু অপেক্ষা কর। খবর পেলেন তোফায়েলও অবরুদ্ধ। বাবা আমাদের বললেন, জীবনে যা কামাই করেছি তা শেষ হয়ে গেল।

বিকাল তিনটায় আর্মির একটি দল আমাদের বাসায় আসেন। তারা আামাদের পরিবারের সদস্যদের তালিকা নিয়ে যায়। এর পরপরই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের আনাগোনা বেরে যায়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। বিকেল পাঁচটায় আর্মির দুইটি গাড়ি ও একটি সাদা প্রাইভেট গাড়ি আমাদের বাসার সামনে অবস্থান নেয়। আর্মির সদস্যরা আমাদের বাসায় প্রবেশ করে বাবাকে বন্দুকের মুখে বললেন’ আপনাকে নিতে এসেছি।’ বাবা তখন অসুস্থ ছিলেন। তিনি শুধু তাঁর মা ( আমার নানী) কে বললে ‘ মা ফিরে না আসলে আমার জন্য দোয়া কর।’ বন্দুকের মুখে তারা আমার বাবাকে নিয়ে গেলেন।

একটি কথা বলতে হয় ওই মাসের ২০ আগস্ট আমার বড় বোনের বিয়ের দিন ধার্য ছিল। ওই বিয়েতে অংশ নেওয়ার জন্য ১৫ আগস্ট আমরা সবাই সিলেট যাওয়ার কথা ছিল।

খবর পেলাম বাবাকে বঙ্গভবনে নিয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে দেখলেন ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরো অনেকে। কিছুটা সময় পর হল রুমে সবাইকে নেওয়া হলো বন্দুকের মুখে। সেখানে মোস্তাক ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর নেই। মোস্তাক জানালো পার্লামেন্ট বহাল আছে। মন্ত্রীদের শফথ রাত ৭ টায়। বন্দুকের মুখে রাত ৭ টায় সম্পন্ন হয় শপথ অনুষ্ঠান। গঠন করা হয় মন্ত্রীসভা। রাত ৯ টায় বাবাকে বাসায় দিয়ে যায়। বাবা ফিরে এসে বললেন ‘ আমার জিন্দাকবর হয়ে গেছে।’