সুনামগঞ্জে ধান নিয়ে বিপাকে কৃষক

শুভেন্দু শেখর দাস, সুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকদের দুর্ভোগ আর দুর্দশা যেন পিছু ছাড়ছেনা। বৃষ্টি, খড়া ও বন্যায় পর পর কয়েক বছরে বোরো ফসল কৃষকদের ঘরে না উঠার কারণে কৃষি নির্ভর প্রায় ৯০ ভাগ কৃষক পরিবার দিন দিন দরিদ্রতার চরম সীমায় চলে যাচ্ছেন। এক ফসলী বোরো ফসলকে ঘিরেই হাওরের কৃষকদের সব স্বপ্ন। ফসল ভালো হলে কৃষকদের মনে যেমন সীমাহীন আনন্দ বিরাজ করে, ঠিক তেমনই ফসল নষ্ট হলে তাদের জীবনে নেমে আশে অন্ধকার। গেল কয়েক বছরের ফসল নষ্টের কারণে বহু কৃষক বাপ-দাদার বুনিয়াদী কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। এবার আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্ঠায় কৃষকরা তাদের বাপ দাদার বুনিয়াদী বোরো ফসল রোপন করেও দুর্দশা থেকে মুক্তি পায়নি।

বহু কষ্টাজিত ফসল রোদের অভাবে ধান না শুকাতে না পারার কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা জানিয়ে জামালগঞ্জের পাকনার হাওরের ফেনারবাঁক গ্রামের কৃষক সাজিদুর রহমান বলেন, বেপারী নাই, তবুও কষ্ট কইরা ধান কাটার পর এই ধান তিন টানা হইছে। মাড়াই দিয়া খলায় রাখছি এখন মেঘের লাইগা ধান শুকাইতে পারিনাই বড়ই সমস্যায় পড়ছি। রোদ নাই ১০-১২ দিন ধইরা, ধান শুকাইতা পারতাছিনা, এখন ধানে গেরা হইছে। ২ হাল জমি রোপাইছিরাম (২৪ কেদার) সব জমির ধান কাটতে পারিনাই। মেঘে আর ফাইন্যে ধান নষ্ট কইরা গেছে। মাত্র কিছু ধান শুকাইয়া গোলায় উঠছে। আরো শতেক মণ ধান শুকাইবার লাগি খলায় রাখছি। সব ধানের মাঝে গেরা (চারা ) আইছে। এইডা শুধু আমার একলা না, সব কৃষকের এমই দশা। এখন রোদ না উঠলে সবারই ধান নষ্ট অইব। শুধু সাজিদুর রহমানই নয়, রোদ না থাকায় ভিজা ধান শুকানো নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে আছেন সুনামগঞ্জ জেলার হাজার-হাজার কৃষক ও গৃহস্থ পরিবার। ধর্মপাশা উপজেলার বাবুপুর গ্রামের কৃষক মোহন মিয়া জানান, হাওরের ধান কোন রকম কাইট্রা কষ্ট কইরা ধান বাড়িতে নিয়া মাড়াই দিয়া খলায় রাখছি। এখন কয়েক দিনের মেঘে এই ধান নষ্ট কইরা ফালাইছে। ১২ দিন ধইরা খালি মেঘ আর রইদ, খলায় ধান শুকাইবার কোন সুযোগই নাই। ধানের গেরা দেইখা মনটা খারাপ হইয়া গেছে। সরেজমিন ঘুরে হাওরের মানুষের ধান ঘরে তোলার দুর্ভোগ নিজের চোখে না দেখলে বিশ^াসই করার মতো না। কৃষাণ-কৃষাণী, নারী-পুরুষ, এমনকি শিক্ষার্থীরাও বসে নেই ধান তোলার কাজে। কোমর বেঁেধ হাটু পানি-উঁড়– পানিতে ধান তুলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। জানা যায়, জেলার ১১ উপজেলা জুড়ে কৃষকদের একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত ১০-১২ দিন ধরে মুসলধারের বৃষ্টিতে ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো কোনো কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়া আর বজ্রপাত আতংক পিছু ছাড়ছেনা কৃষকদের। মাড়াইকৃত ভেজা ধান নিয়ে চরম দুর্ভোগ আর দুর্দশায় পড়েছেন হাওরের কৃষকেরা।

কৃষি বিভাগ দাবি করছে, হাওরের বেশীর ভাগ ধান কাটা হয়েছে কিন্তু কৃষকরা বলছেন এখন হাওরে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ ধান কাটার বাকী রয়েছে। মাড়াইকৃত ও শুকানোর বাকী আছে আরো ১৫-২০ ভাগের মতো। কৃষক বজলুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমার কৃষি কাজ প্রায় ছাড়ার মতোই, রোপনরে সময় কাজের লোকের অভাব. আবার এখন মাঠে পাকা ধান কিন্তু শ্রমিক নাই, সব মিলিয়ে গড় পরতায় পোষেনা। এর জন্য অনেকই ধান কাটতে পারছেনানা। পাকানা হাওরে জমি রোপন পিছিয়ে যাওয়ার কারণে ধান পাকতে অনেক দেরী হয়েছে। এখন কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বেশির ভাগ জমি পানিতে যুবতেছে। কাট ও মাড়াই ধান রোদে শুকাতে পাছেননা কৃষকরা, এত ধানে চরম ক্ষতি হচ্ছে। চলতি বোরো মওসুমে বোরো ধান রোপনের সময় থেকে শুরু করে পাকা ধান কাটতে শ্রমিক সংকটসহ এখন পর্যন্ত কৃষকরা ভোগান্তিতেই রয়েছেন। আবহাওয়া অফিস বলছে অরো এক সপ্তাহ যাব আবহাওয়া এভাবেই থাকবে, এমনটি প্রচার হওয়ায় ধান নিয়ে চরম চিন্তিত হয়ে পড়ছেন কৃষকেরা। প্রতি দিন ঝড়-বৃষ্টি আর বজ্রপাতের ভয়ে হাওরে ধান কাটা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। যে সব ধান কেটে বাড়ি নিয়ে এসছেন কৃষকরা তাও মাড়াই করছেন না রো না থাকায়। কারন মাড়াইকৃত ধান শুকাতে না পাড়া ও গেরা (চারা) গজানোর ভয়ে এমনিতেই ষ্টেক করে রেখেছেন খরায় ও মাড়া খলায়। কৃষকদের বাড়িতেও ভিজা ধান রাখার জায়গা নেই। এ কারণে ধান নিয়ে পড়েছেন উভয় সংকটে।

জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-আজাদ বলেন, ভারি মেঘের কারণে আর রোদ না থাকায় হাওরের কৃষকরা এখন চরম দুর্ভোগে আছেন। বৃষ্টির কারণে আর বজ্রপাতের ভয়ে ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো কোনো কিছুই করছে পারছেন না কৃষকরা। হাজার হাজার কৃষকের ভিজা ধানে চারা উঠছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার সাহা নয়া দিগন্ত কে বলেন, কয়েক দিন যাবৎ বৃষ্টির জন্য ধান শুকাতে কৃষকদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে এখ নপর্যন্ত হাওরের বেশিরভাগ ধান কাটা ও শুকানো হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের সর্বভাটি জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লার কয়েকটি হাওরে আংশিক নীচু জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আশা করি রোদ হলে কৃষকরা এগুলো কাটতে পারবেন।