৭১ এর প্রথম দিনগুলো

 

কয়েস গাজী

বাবার সাথে ৬০-৭০দশকে আমি সাথে ঘুরেছি অনেক থানা মহকুমা। ১৯৬৯ সালে মিজান সাহেব আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফরে সিলেট আসেন। তখন তিনি বৃহত্তর সিলের সফর করেন ।আমিও তাদের সাথে গাড়িতে করে যাই। তখন থেকেই সব জায়গায় মানুষের সাথে পরিচিত হতাম। দেওয়ান ফরিদ গাজীর ছেলে হিসাবে। সেদিনের আওয়ামী লীগ আর আজকের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে পার্থক্য করা হতো ।আজ আওয়ামী লীগ তৃনমুল নেতাকর্মীদের দূরে রেখে তথাকথিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নামধারী দলকে জিম্মি করে রেখেছে।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার গঠনের দায়িত্ব প্রদান করে। কিন্তু এহিয়া ও ভুট্টোর যোগসাজশে বাঙ্গালীর রায়কে উপেক্ষা করে বাঙ্গালীকে নিধন করার অভিযান চালু করে। ৭০ সালে নির্বাচন পর পাক বাহিনীর মেজর সরওয়ার আমার বাবাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে তোমাকে না পারি তোমার বউ বাচ্চাদের ধরে এনে রাখবো। তখন তোমাকে ধরা দিতেই হবে। আমার বাবাও প্রতি উত্তর দিয়ে বলেছিলেন আমিও তোমায় দেখে নিবো। তুমি কিভাবে থাকো এখানে।

৭১-র ফেব্রুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহ। প্রতিটি মূহুর্তে গোয়েন্দা নজরদারি রাখতো। সেই সময় থেকেই বাবা আত্মগোপনে চলে যান। তখন থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ছিলাম। আমাদের বাসায় তৃনমুল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। আমরা যখন স্কুলে যেতে পারতামনা তাদের ভয়ে। আমার বড়ভাই গাজী মোঃ শাহনওয়াজ (মিলাদ গাজী) রেসিডেন্সিয়েল স্কুলে পড়তেন। তাকেও স্কুল থেকে বাসায় আনানো হলো। আমার বড় চাচা সবাইকে নিয়ে নবিগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। আমি কয়েছ আমার বড়বোন শামীমা ও জময ২ ভাই। যাদের নাম বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তাদের জন্মের পর জয়-বাংলা (যাহেদ ও সাহেদ) পরে রাখা হয়। আম্মা দাদী সহ সিলেট থাকলাম।২২, ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি জনগণ স্বতস্ফূর্ত ভাবে লাঠি মিছিল করে শহর প্রদক্ষিন করে । সমগ্র পূর্বপাকিস্তান এক মৃত পূরিতে পরিণত হয়। ৭১ সালের ২৪ মার্চ ক্যাপ্টেন মোতালিব ইপিআর বাঙ্গালী আমাদের বাসায় আসেন। আব্বার সাথে কি কথা বলে চলে যান। যতদূর মনে পরে বলেছিলেন আপনারা যেখানে যে অবস্থায় আছেন সে অবস্থা থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলে বাঙ্গালীদের নিয়ে আত্মরক্ষা করে যুদ্ধে যান। সময় নেই চলে যান। আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল নানুর বাড়ি কোয়ারপার।

২৪ মার্চ রাতেই বাসা শূন্য রেখে জরু ভাই জয়নাল ভা্ইকে রেখে চলে যাই। রাতেই পাকবাহিনী বাসায় রেইড দেয়। ধরে নিয়ে যায় জরু ভাই আর জয়নাল ভাইকে। আমরা কোয়ারপার নানুর বাড়িতে আত্মগোপনে থেকে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ এই তিনদিন মৃত অবস্থায় ছিলাম। ২৭ মার্চ দুপুর বেলা হানাদার বাহিনী কোয়ারপার নানুর বাড়িতে হানা দেয় আমাদের ধরার জন্য। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী পিছনের বাড়িতে লস্কর সাহেব পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন তার বাসায় আশ্রয় নিলাম। জময ২ ভাইকে কূলে নিলাম আমি আর বোন শামীমা এক ভাইকে নিলেন। ভাই মনে করে কাগজের একটা পুটলা নিয়ে গেলেন আম্মা। আম্মা অস্থির, আমার আরেক ভাই গেলো কোথায়। বড় বোন শামীমা বললেন আছে এখানে। শান্তনা পেয়ে তখন খতমে ইউনুস পড়ছিলাম সবাই। এদিকে আমার বড় মামা সদ্যবিবাহিত। মামাকে এক পেয়ে ধরে নিয়ে যায়। সার্কিট হাউস পরে থানায় নিয়ে প্রচন্ড টর্চার করে। ১দিন পর জেলে পাঠিয়ে দেয়। কারণ তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ধারী ছিলেন।

আমরা ঐদিন আল্লাহ হুকুমে রক্ষা পেয়ে হানাদার বাহিনী যাওয়ার পর চলে গেলাম- মহবুব খা যাকে সবাই জানতেন কুয়ারপারের প্রবিন বিচারক মবু খা নামে। তার বাড়িতে ও টেনু মামুদের বাড়িতে থেকে চলে যাই হাজী আবদুল বারীর বাড়িতে। সেখান আমরা কয়েকদিন অবস্থান করি। কার্ফিউ শিথিল করলে আমরা চলে যাই গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ী আমার নানার বাড়িতে। ইতিমধ্যে আমাদের সাথে সিলেট দেখা করেন দেওয়ান তৈমুররাজা সাহেব ‘আমার মায়ের বড় মামা’ কোয়ারপার নানুর বাড়িতে দেখা করেন। হাতে ২০০ টাকা দিয়ে বললেন জময ২ ভাইয়ের খাবার কিনে নিতে।

এলেন সিরাজউদ্দীন আহমদ আর আনোয়ার হুসেন গোরা। তার আজ বেঁচে নেই। তারা এসেছিলেন কার্ফু মাঝে। আমার সাথে প্রথম দেখা। তারপর আম্মার হাতে কিছু টাকা দিয়ে চলে গেলেন ।আমরা বলে দিলাম আমরা ফুলবাড়ী চলে যাবো। একটি বেবীট্যাক্সি ভাড়া করে বাসস্ট্যান্ডে দক্ষিণ সুরমায় যাই। সেখানে আপার ক্লাসের ২ নং সারীর সীটে বসি। এক ভাইকে আম্মা আর এক ভাইকে বড়বোন শামীমা কূলে নিয়ে বসেন বাসে। আমি আর বারী হাজী সাহেব পাশাপাশি বসি। বাস ছাড়লো। হেতিমগঞ্জ অতিক্রম করার পর ফুলবাড়ী ইউনিয়ন অফিসে চেকপোস্ট। সেখানে বাস থামিয়ে চেক করতে থাকে। সেদিনও রক্ষা পেলাম হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। আস্তে আস্তে বাস চলতে থাকলো। একজন আমাকে চিনে নিলেন। বললাম ভাদেশ্বর যাবো। আর কোনো কথা বলা হয়নি। আমরা নেমে গেলাম মোকামের তল বলে পরিচিত ফুলবাড়ী। বারী হাজী সাহেব আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসেন অন্য বাসে করে। ফুলবাড়ীতে আমরা ১০-১২ দিন অবস্থান করি। কিন্তু বাবার সাথে দেখা নেই। প্রায় ২৫-৩০ দিন।

একদিন হঠাৎ এক ভাতিজা রাতে আসেন আমদের সাথে দেখা করার জন্য। আম্মার সাথে আলাপ করে বললেন রাতেই আমাদের বাড়িতে আসতে হবে। শুধু বললেন দাদা আসবেন। আম্মার বুঝতে বাকি রইলোনা। কনকনে শীতের রাতে আম্মা আমি আর বড়বোন আব্বার সাথে দেখা করলাম আমাদের ফুফুতো ভাইয়ের বাড়িতে। শুধু বললেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। পরদিন আব্বাসহ গাড়ি নিয়ে আসলেন আনোয়ার হুসেন গোরা ও মসুদ চৌধুরী। আমরা গড়ীতে উঠলাম। তখন শেরপুর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। রওয়ানা দিলাম। রাস্তা তেমন ভালো নয়। বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, সমসেরনগর, মৌলভীবাজার, শেরপুর হয়ে বাড়িতে পৌঁছাই গভীর রাতে। তখন শেরপুর শত্রুমুক্ত। পরের দিন যখন হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে তখন মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে থাকে। কারণ তাদের কাছে ভারী অস্ত্রের অভাব ছিলো। আব্বা আমাদের জন্য গাড়ী নিয়ে যান। সবাইকে নিয়ে আবার আমরা পাল্লাতল চাবাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।৷

বিকাল বেলা সন্ধার পর রাত্রি অনেক হলো। মৌলভীবাজার পৌছিলাম রাত ১টার দিকে। মহসীন আলী মামু ও সৈয়দ মতিন এবং আলী আহমদ খান যাকে (তখনও বুঙ্গা খান বলে ডাকতেন) চৌমুহনীতে। আব্বার সাথে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করলেন এবং দ্রুত শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বললেন। আমরাও রাত্রি যাপন করি কালীঘাট চাবগানের রেস্ট হাউসে। ভোরবেলা পাল্লাতল বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । বড়লেখা হয়ে গিয়ে পৌঁছাই বিকাল বেলা। সেখানে আমাদের খালা থাকতেন। খালু কোরেশী সাহেব ছিলেন ম্যানেজার। শামীম কোরেশীর বাবা। শেখ পাড়া শেখ হাউস শেখ নাসির(রঃ) এর মাজার প্রাঙ্গণে। পাল্লাতল চা বাগান ছিল অজিত চৌধুরীর।

১৫-২০ দিন থাকার পর পাক হানাদার বাহিনী যখন বড়লেখা দখলকরে নেয় তখন গভীর রাত আমরা সবাই এক সাথে খালতো ভাইবোনসহ ভারতের করিমগঞ্জ জেলায় মধ্যরাতে পৌঁছি। রাত্রি যাপন করি চিত্রবানী সিনেমা হলে। চিত্রবানী সিনেমা হল ছিলো পটল বাবু, ভুলু বাবু, আলু বাবু অর্থাৎ সাধু বাবুর পরিবারের।

আমি আব্বার সাথে বাহির হলাম করিমগঞ্জ শহরে। পরের দিন আমরা স্থানীয় একটি কলেজে আশ্রয় নিলাম। সেখানে ৫-৭ দিন থাকার পর আমরা চলে যাই স্থানীয় নিত্যভূষন দাসের বাড়িতে। কলেজে থাকাকালীন সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নি ডাক্তার নজরুল আলম চৌধুরীকে পাই। সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি দেখে চিনে তুলে নিলাম গাড়িতে। আব্বা বললেন উঠেন গাড়িতে। তিনি গাড়িতে উঠার পর ভারতীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেন। এর পর আগরতলা যান। সেখানে জরুরি সভা ছিলো। মসুদ চৌধুরী সাহেব চালক ছিলেন। কিন্ত পথিমধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত হলে আর যেতে পারেননি।